Nargisi Kofta and Narcissus

কোফতা কাহিনী

Nargisi Kofta from Hanglaatherium

মোঘলরা না আসলে আমাদের ভারতবর্ষের খাওয়া দাওয়া কেমন হতো সেই নিয়ে একটা বড় প্রশ্ন সবসময়ই থেকে যায়। বেশিরভাগ সময় যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও তাদের খাবারদাবারের প্রতি আগ্রহ প্রায় পাঁচশো বছর পরেও মানুষের রুটি রুজির বন্দোবস্ত করে চলেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের সীমানা ছেড়ে আজ গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে মোগলাই খানার স্বাদ পৌঁছে গেছে পরিব্রাজক থেকে সৈন্য সামন্ত শাসকের হাত ধরে। মূলতঃ পারস্য মোগলাই খাবারের উৎস হলেও এর মধ্যে বেশ কিছু মৌলিকত্ব ছিল। প্রচুর খাবার কাশ্মীর বা দিল্লীতেও তৈরি করেছিলেন বাদশাহদের বাবুর্চি,  খানসামারা। কাশ্মীরি রোগান জসের সম্পর্কে অল্পবিস্তর যা জানি সেটুকু লিখেছিলাম আগেই। এখন কাশ্মীরি নার্গিসি কোফতা নিয়ে একটু বলি। 


সহজ ভাষায় কোফতা হলো মাংসের মন্ড বা দেশী meat loaf বললে বোধহয় অত্যুক্তি করা হবে না। পারস্যের কাফতা থেকে কোফতা শব্দটি আসে এবং ইরাক, ইরান, আর্মেনিয়ার লোকজন কিন্তু এই কাফতা খেয়ে আসছে মাখা মাখা ঝোলের সাথে রুটি দিয়ে। আমরা তো ভাত, রুটি, মুড়ি যা পাই সেটা দিয়েই মেরে দি। কদিন আগে দমদমের ঢাকাই হান্ডিতে চিংড়ির কোফতা সাবড়ে দিলাম তেহারি দিয়ে। লোকে অনেক কিছু বলবে এটা দিয়ে ওটা চলে না, ওটা দিয়ে সেটা খেয়ে হয়। আমার বাপু মেরী বিস্কুট ভাতের সাথে মেখে ভালো লাগলে আমি সেটাই খাবো। যাই হোক, সে সব কথায় না গিয়ে নার্গিসি কোফতার গল্পে আসা যাক।

Prawn Kofta from Dhakai Handi

নার্গিসি কোফতা আমি প্রথম খাই হ্যাংলাথেরিয়ামের লেকগার্ডেন্স আউটলেটে। আমি রেঁস্তোরাতে গেলে কতগুলো নিয়ম মেনে চলি, 

১। খাবার দিতে দেরি হচ্ছে, মানে একদম টাটকা বানিয়ে দিচ্ছে, আগের বানানো জিনিস দিচ্ছে না। 

২। খাবার যখন দিতে দেরি হচ্ছে তখন যে খাবারটা অর্ডার করেছ সেটা নিয়ে একটু পড়াশুনা করে সময় কাটাও। এটা অনেকটা সুন্দরী প্রেমিকাকে জেনে বুঝে নিয়ে বিয়ে করার মত। নাড়ি নক্ষত্র, ইতিহাস ভূগোল জেনে নেবার মত। একলাফে ফুল সজ্জা ব্যাপারটা ঠিক জমে না। খাবারের সাথে প্রেম সখ্যতা না হলে কি খাবারের আসল রস আস্বাদন করা যায়!!! আমি দলবল নিয়ে খুব একটা খেতে যাই না, গেলে এসব করা যায় না, তাদের সাথে সেল্ফিতেই সঙ্গ দিতে হয়। 


সেল্ফি বলতে মনে পড়লো সেল্ফি তোলাটা কিন্তু একপ্রকার Narcissm. আর এই Narcissm এর সাথে নার্গিসি কোফতার একটা সুন্দর সংযোগ আছে। যারা আমার বাজে বকার লিখিত সংস্করণের এত দূর অবধি পড়ে ফেলেছেন, দয়া করে এটা ভেবে চলে যাবেন না বাবুর্চি রান্নার সময় সেল্ফি তুলে Narcissm দেখাতো বলে তার বানানো কোফতার নাম নার্গিসি কোফতা। বাজে না বকে এবার আসল গল্পে আসা যাক।

Image Courtesy: Google


গল্পের শুরুটা গ্রীস থেকে। গ্রীক মাইথোলজি অনুসারে মধ্য গ্রীসের Boeotia অঞ্চলে এক প্রাচীন শহর ছিল যার নাম Thespiae, যা বর্তমান Mount Helicon পাহাড়ের কাছে Thespies গ্রামের অনতিদূরে অবস্থিত। এই শহরে থাকতেন এক শিকারি, নাম Narcissus, বাবা Cephissus, নদীর দেবতা, থাকতেন Athens এর কাছে Cephissus নদীতে আর মা Liriope ছিলেন Thespiae এর এক অশরীরী আত্মা, যাকে জলাশয়ের ধারে, ঝর্ণার ধারে বা কুয়োর ধারে পাওয়া যেত। Cephissus এবং Liriope এর কিন্তু বিয়ে হয় নি, Cephissus Liriope কে ধর্ষণ করে আর তারপর জন্ম নেয় এই Narcissus। Narcissus ছিলেন অসম্ভব সুন্দর একজন পুরুষ। Byzantine কবি John Tzetzes এর লেখা থেকে জানা যায় তিনি বাহ্যিক প্রণয়মূলক সমস্ত আকর্ষণ পরিত্যাগ করে ঝিলের জলে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেন। ঠিক যেমন আজকের যুবসমাজ Tiktok, Insta reels করে খানিকটা ওই রকমই বলতে পারেন। সে যাই হোক, তাদের মোবাইল, তাদের ইন্টারনেট , তারা করতেই পারে - আমার আপনার কি! ফেরা যাক গল্পতে। এই Narcissus ভদ্রলোকের কার্যকলাপ থেকেই Narcissism শব্দটির উদ্ভব। এর সাথে এখনো নার্গিসি কাবাবের সংযোগ এখনো স্থাপন হয় নি, আপনাদের আরেকটু ধৈর্য ধরতে হবে। Narcissus এর মৃত্যুর পর ওখানকার মানুষ লক্ষ্য করেন, উনি ঝিলের পাড়ে যেখানে বসে নিজেকে দেখতেন সেই জায়গায় এক ধরনের ফুলের গাছের ঝোপ হয়েছে। সেই ফুলের নাম দেওয়া হয় Narcissus। একটু সহজ করে বললে, আমরা যারা ছোটবেলায় William Wordsworth এর I Wandered Lonely as a Cloud পড়েছি, 

I wandered lonely as a cloud
That floats on high o'er vales and hills,
When all at once I saw a crowd,
A host, of golden daffodils;
Beside the lake, beneath the trees,
Fluttering and dancing in the breeze.



Daffodil
এই Narcissus হলো সেই Daffodil ফুল। এর বাইরের দিকটা সাদা আর ভেতরের দিক হলুদ। মোঘলরা Narcissus কে বলতো নার্গিস। আমার মতোই কোনো খাদু পাবলিক যে প্রকৃতির romantisim এর মধ্যেও খাবার খুঁজে পায় সেরকমই কেউ একজন এই বাইরে সাদা , ভেতরে হলুদ daffodil দেখে সেদ্ধ ডিমকে মিস করেছেন। ব্যস, রসুইঘরে গিয়ে ডিমের কোফতা বানালেন আর নাম হয়ে গেল নার্গিসি কোফতা। 





Egg Devil from Dilkhusa Cabin

মোঘল সাম্রাজ্যের পড়ন্ত বিকেলের দিকে এসেছিল ইংরেজরা। এখান থেকেই বিভিন্ন মহাদেশে বিভিন্ন নাম নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে এই নার্গিসি কোফতা। 1700 শতাব্দীর মাঝামাঝি ইংরেজ সৈন্যরা দেশে ফেরার সময় জিভে স্বাদ আর মনে আকাঙ্খা নিয়ে ঘরে ফিরে তাদের মত করে কিছু একটা বানান, যেখানে গ্রেভি ছিল না - ছিল Tomato Puree, ডিম সিদ্ধর বাইরের পুড়ে আমাদের যেমন মাংসের কিমা থাকে ওরা সেখানে সসেজের মাংস, ফিশ পেস্ট ইত্যাদি দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। ইতিহাস ঘেঁটে যা পেলাম, তাতে লন্ডনের Fortnam and Mason নামের departmental store থেকেই নার্গিসি কোফতার প্রথম ইংরেজি সংস্করণ বিক্রি করা শুরু হয়েছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি Yorkshire এর William J Scott & Sons রেস্তোরাঁ নার্গিসি কোফতা বানিয়ে বেশ সুনাম করেন এবং মনে করা হয় তার এই Scott নাম থেকেই Scotch Egg নাম আসে। এখন ইংরেজদের যেমন চুরির স্বভাব। টিক্কা বাটার মাসালার মতো Scotch Egg ও হয়ে গেল ওদের রেসিপি। আর আমরা ওদের থেকে নাকি এটা কপি করেছি। আমার ছোট ভাইয়ের স্বভাবটা এমনই - আমার জিনিস নিয়ে নিজের নামে চালায়। ব্রিটিশদেরও ওই ছোটভাই বলে ক্ষমা করতে হয়। এখন, ঝগড়া তো করা যায় না UN এ গিয়ে নার্গিসি কোফতা বা টিক্কা বাটার মাসালার জন্য।


 এবার এই কোফতা আমেরিকা গিয়ে নাম নিল কোথাও Stuffed Egg , কোথাও Angel Egg আবার কোথাও salad দিয়ে খাওয়া হয় বলে Salad Egg। এবারে যখন ব্রিটিশদের হাত ধরে নার্গিসি কোফতা পরাধীন ভারতের রাজধানী কলকাতাতে ফিরে এলো বিলেত ফেরত খাবার হয়ে। পুরো খোল নোলচে পাল্টে, গ্রেভি হাওয়া করে এক sophisticated ব্যাপার স্যাপার। রুটি দিয়ে খাবার জিনিস এখন ছুরি কাটাচামচ দিয়ে খেতে হয় আর সাথে থাকে কাসুন্দি, টমেটো সস, শসা কুচি, পিঁয়াজ কুচি ইত্যাদি। তবে বাঙালিদের স্বাদকোরকে এটি খুব একটা দাগ কাটতে পারে নি। বাঙালিরা আবার এখানে আরেকটু কিছু নিজেদের মতন করে সংযোজন করে, কারন ইংরেজরা বেশি মশলাদার খাবার খেত না, আর আমাদের মশলা ছাড়া খাবার চলে না, তাই বাইরের পুরে যোগ হল গোলমরিচ, লংকার ঝাল আর দেশীয় মশলাপাতি। বিখ্যাত লেখক Samuel Johnson যাকে আমরা Dr. Johnson নামে চিনি, ওনার বায়োগ্রাফির লেখক James Boswell এই অতিরিক্ত মশলা দেওয়া Scotch Egg খেয়ে এমন ঝাল লাগলো যে উনি এর নাম দিয়ে দিলেন Devil Egg। 

কলকাতার বহু জায়গায় এখন এই egg devil পাওয়া যায়। তবে খাসির মাংসের কিমা দিয়ে যত্ন করে বানানোর জায়গা খুব কম। দামে পোষাতে পারবে না, লোকে অত দাম দিয়ে খাবে না। তাই ওই বাজার চলতি একটা বড় ডিমের চপ egg devil নামে চলছে। 


Egg Devil from Cup e বং


তবে হ্যাঁ, ভালো হাঁসের ডিমের Egg Devil খেতে হলে মুকুন্দপুরের কাছে Cup এ বং আছে। +91 98743 66645






আর নার্গিসি কোফতা হলে Hanglaatherium তো আছেই। ওনারা আবার এই কোফতাটাকে গ্রেভি ছাড়া বানায়, তখন এটাই হয়ে যায় নার্গিসি কাবাব। তবে গ্রেভিতে মশলা বেশি থাকায় স্বাদ এবং সুখ অনেক বেশি।  +91 98308 33999



আর, দমদমের Dhakai Handi থেকে চিংড়ির কোফতা চেখে দেখতে পারেন - আসলে কোফতার texture কেমন হয়। +91 91634 32272


তথ্যঋণ : নোলা - কৌশিক মজুমদার

Comments

  1. এই জন্যই মানুষ টা কে এত ভালো লাগে আমার। গল্পটা খুব সুন্দর, খাওয়ার এর আগে মানুষ টার প্রেমে পড়তে হয়❤️❤️

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular Posts