Do Pyaza


দুই পিঁয়াজের গপ্পো



কদিন আগে অন্তরাত্মা দোপেঁয়াজা খাওয়ার জন্য আনচান করছিল।এদিক ওদিক দেখে আনিয়ে খেয়ে নিলাম। খেতে মন্দ ছিল না, তাই একটু ইতিহাস খোঁজার পোকা মাথায় নড়তে থাকলো। খাবারটা যেহেতু মোঘলাই, তাই নেশাটা প্রবলভাবে জেঁকে বসেছিল। মোঘলাই রান্নার স্বাদ এবং ইতিহাসের প্রতি আমার দুর্বলতা চিরকালেরই।

শুরু করি একটু মাধ্যমিকের মোঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস দিয়ে। 1526 এর পানিপথের যুদ্ধে বাবর না জিতলে আজ আমরা কি খেতাম ভগবানই জানেন। যদি বলি বাবরই ভারতবর্ষের মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করার পথিকৃৎ - তাহলে তর্কসাপেক্ষে বিরাট কিছু ভুল বলা হবে না। শুরুতে বাবরের দেশটাকে খুব একটা পছন্দ হয় নি। তিনি লিখে গেছেন, "there is no ice, cold water, good food, good bread in the markets.” এবং “there is no grapes, quality fruits, mask melons, candles, hamams, torches”; ইত্যাদি ইত্যাদি। এই অতৃপ্তির জন্যই আজ আমাদের কাছে মোঘলাই খাবারের এত বৈচিত্র্য।    যেহেতু জীবনের বেশীরভাগ সময়টাই যুদ্ধ করে কাটিয়েছেন, তাই তাঁবুতে রান্না করে খাওয়া যায়, কম মশালযুক্ত সাধারণ মাংসের preparation, যেগুলো মূলতঃ আফ্রিদী গোত্রীয় যাযাবর সম্প্রদায় রান্না করে থাকে সেইসব রান্নাই বেশি পছন্দের ছিল তার। তবে বাবরনামা থেকে জানা যায় উনি প্রচুর পরিমানে ফল এবং শাকসবজি পছন্দ করতেন। লোধীকে পরাস্ত করার পরে বাবর লোদীর রসুইখানার কর্মচারীদের বিতাড়িত করেন নি। এর ফল স্বরূপ তাকে একসময় খরগোশের স্টু'তে বিষ মিশিয়ে খুন করার পরিকল্পনা করে তাদেরই মধ্যে একজন। বাবর খাবারের গ্রাস মুখে নিয়েই বমি করে ফেলে দেওয়ায় সেই যাত্রায় তিনি বেঁচে যান।  তারপর থেকেই তিনি রান্নাঘরে ভারতীয় পাচকদের  প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করেন।

শুরু যখন মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবরকে দিয়েই হলো, তাহলে লেখার বিস্তারের জন্য তার বংশবিস্তার খুব প্রয়োজন। আসি বাবরের ছেলে হুমায়ুনের প্রসঙ্গে - বাবর ভারতীয় পাচকদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করলেও তার ছেলে হুমায়ুন কিন্তু তার পথ অনুসরণ করেননি। 1539 সালে শেরশাহ সুরি  দিল্লির মসনদ করায়ত্ত করার পর তাকে জীবনের অনেকটা সময় নির্বাসনেই কাটাতে হয়। সেই সময় তিনি ইরানের শাহের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে গেলে তিনি শাহকে ভারতীয় রন্ধনশৈলীর উপরে লেখা একটি বই উপহার দেন। আর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইরানের শাহ ভারতীয় রান্না, বিশেষত খিচুড়ির অনুরাগী হয়ে পড়েন এবং শাহের আতিথেয়তায় এবং পারস্যের রাজকন্যাকে বিবাহের সূত্রে হুমায়ুনও পারস্যের রান্নার অনুরাগী হয়ে পড়েন। 1555  সালে শের শাহের মৃত্যুর পর দিল্লির মসনদে হুমায়ুন যখন দ্বিতীয়বারের জন্য বসেন সেই সময় পারস্য থেকে বহু শিল্পীর সাথে বাবুর্চিরাও ভারতে আসেন এবং সাথে করে নিয়ে আসেন পোলাও, নানারকম কোফতা এবং  তন্দুরে পোড়ানো মাংসের রন্ধনশৈলী।

হুমায়ুনের আয়ুষ্কাল আর রাজত্বকাল দুইই কম ছিল, সেই তুলনায় আকবর অনেক বেশি সময় পেয়েছে রাজত্ব করার। সাথে আমরাও পেয়েছি খাবারে আরো অনেক অনেক বেশি বৈচিত্র্য।
1556 সালে হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মাত্র 13 বছর বয়সে আকবর বৈরম খানের তত্ত্বাবধানে রাজত্বের দায়ভার গ্রহণ করেন।  সম্রাট আকবর কে আমরা যেমন জানি একজন যোগ্য প্রশাসক হিসাবে, ঠিক তেমনি তিনি বিখ্যাত একজন ভোজন রসিক হিসেবেও।  আকবর এর থেকেও আরো বড় একজন ভোজন রসিক তার রাজসভায় ছিলেন। তিনি হলেন আইন-ই-আকবরী রচয়িতা আবুল ফজল।
 
 আইন-ই-আকবরীতে আবুল ফজল  বাদশা আকবরের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন, “His Majesty (Akbar) even extends his attention to this department, and has given many wise regulations for it; nor can a reason be given why he should not do so, as the equilibrium of man’s nature, the strength of the body, the capability of receiving external and internal blessings, and the acquisition of worldly and religious advantages, depend ultimately on proper care being shewn for appropriate food. This knowledge distinguishes man from beasts, with whom, as far as mere eating is concerned, he stands upon the same level.”  তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওনার খাবার গ্রহণের পরিমাণও অনেক কমে যায়।  বেশিরভাগ সময় তিনি খাবার সম্পূর্ন শেষ না করেই উঠে যেতেন।  একটা সময় এসেছিল যখন তিনি সারাদিনে কেবলমাত্র একবারই খাবার খেতেন।  আকবরের খাবার নিয়ে যখন কথা হচ্ছে তখন তার রসুইখানার উল্লেখ একবার হলেও করতেই হয়।  মীর ভাকওআল ছিলেন তাঁর রসুইখানার মুখ্য তদারক। ওনাকে শুধু রসুইখানার তদারক বললে ভুল হবে, উনি ছিলেন বাদশাহের প্রধান টেস্টার। ওনার কাজ ছিল রান্না হবার পর সবার আগে খাবারের গুনগত মান এবং স্বাদ পরখ করা এবং তারপর খাবারের পাত্রকে বন্ধ করে বাদশাহের কাছে পাঠানো। এরপর বাদশাহের সামনে আবার খাবার গুলো খেয়ে তাকে আশ্বস্ত করা , খাবার সম্পূর্ণভাবে বিষমুক্ত।  সম্রাট আকবর সাধারণত একা খেতে পছন্দ করলেও মীর ভাকওয়াল তার খাওয়ার সময় সর্বদা পাশে থাকতেন। জীবনে একটা সময় সম্রাট আকবর মাংস খাওয়া থেকে নিজেকে পুরোপুরি বিরত রাখেন।  তিনি নির্দেশ জারি করেন যে, শুধুমাত্র খাবার জন্য পশু হত্যা করা যাবে না। তিনি এমনও নির্দেশ দেন যেখানে গরু বা অন্য পশু হত্যা করা যাবে না, যেখানে হিন্দু বা জৈন ধর্মালম্বী মানুষের ভাবাবেগে আঘাত লাগে। আকবর ভীষণভাবে তার রেগুলার রুটিন মেইন্টেন করতেন।  সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার তিনি নিরামিষ ভোজন করতেন।  অনেকে মনে করেন তার এই অভ্যাস  মূলত এসেছে তার রাজপুত স্ত্রীদের কাছ থেকে। বাদশাহ আকবরের আহার তিনটি পর্যায়ে পরিবেশন করা হতো,  প্রথমটি নিরামিষ, দ্বিতীয়টি মাংসের সাথে ভাত এবং তৃতীয়টি মসলাদার মাংস। 
আকবরের বাবুর্চিরা এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে কয়েক ঘন্টার মধ্যে তারা সম্রাটের সামনে  কয়েকশো রকমের পদ হাজির করতে পারতেন।  সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিনি বাবুর্চিদের খুঁজে এনে তাদের আলাদা এক বাহিনী তৈরি করেন।  অজস্র খাবারের মধ্যে সম্রাটের পছন্দের মধ্যে ছিল বিরিয়ানি, কিমা পোলাও, দো-পেয়াজা,  খিচুড়ি, হালুয়া, কাবাব এবং রুটির মধ্যে চাপাটি, কুশকাওয়া ইত্যাদি। মোগলাই ঠান্ডা পানীয়তে ব্যবহৃত হতো বরফ কুচির সাথে নানারকম ফলের রস।  আর এই বরফ আসতো সুদূর হিমালয় থেকে।  আকবর মূলত গঙ্গার জল পান করতেন,  এবং তিনি মনে করতেন গঙ্গার জলে অমরত্ব লুকিয়ে আছে। গঙ্গা থেকে 200 কিলোমিটার দূরে পাঞ্জাবে থাকাকালীনও আকবরের জন্য উটের পিঠে করে গঙ্গা থেকে জল আনা হতো।  A History of Food In India বইয়ে Colleen Taylor Sen লেখেন -  “the palace chickens were fed by hand with pellets flavoured with saffron and rosewater, and massaged daily with musk oil and sandalwood." আকবরের রসুইখানা সম্বন্ধিত বইগুলোতে লেখা আছে, a head cook, a treasurer, a storekeeper, clerks, tasters, and more than 400 cooks from all over India and Persia. Food was served in gold, silver, stone and earthenware dishes, tied in cloths. Ice, used for cooling drinks and making frozen desserts, was brought daily from the Himalayas by an elaborate system of couriers. আকবরের খাবার নিয়ে শৌখিনতার কথা নিয়ে Salma Hussain, food historian জানান , “and had his own kitchen garden which he nourished with rosewater, so that the vegetables would smell fragrant when cooked.” 

তবে খাবারের দিক থেকে আকবরের ছেলে জাহাঙ্গীরকে কুলাঙ্গার বলাই চলে। প্রশাসক হিসেবে কেমন সেটা প্রকৃত ইতিহাসবিদরাই বলতে পারবেন। 1605 সালে আকবরের মৃত্যুর পর বাবার রাজত্ব পেলেও বাবার মত খাবারের প্রতি আগ্রহ জাহাঙ্গীরের ছিল না। তিনি ছিলেন মাদকাসক্ত। এই মোদো মাতালদের নিয়ে বেশি আলোচনা না করে কাজের আলোচনায় আসি, লেখার মুখ্য বিষয় যেহেতু দো-পেঁয়াজা ছিল তাই মোঘল ঘরানার খাওয়া দাওয়ার অল্প ধারণা না দিলে খাবারের প্রতি অতটাও আগ্রহ জন্মায় না। মূল লেখায় আরেকটু পরে আসি, তার আগে একটা ভিডিও দেখাই।


যোধা আকবর সিনেমাটি অনেকেরই দেখা এবং এই সিনটাও বেশ জনপ্রিয় যেখানে বীরবল তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিচ্ছেন। অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে দো-পেঁয়াজার সাথে সিনেমার কি সম্পর্ক। আসলে দো-পেঁয়াজার সৃষ্টিকর্তা হলেন আব্দুল মমিন (1527-1620), যিনি বীরবলের পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। আমাদের কাছে মমিনের কোনো ছবি নেই, তাই প্রতীকি একটি ছবির চেষ্টা করলাম। এই ভদ্রলোকই দো-পেঁয়াজার জনক এবং বাদশাহ সালামতের দো-পেঁয়াজা বেহত পসন্দ হওয়ায় ওনার নাম আব্দুল মমিনের থেকে রাখা হয় মোল্লা দো-পেঁয়াজা। ভিডিওটা আরেকবার গিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন ওনাকে মোল্লা দো-পেঁয়াজা বলেই সম্বোধন করা হচ্ছে। হাফিজ মাহমুদ সিরানীর মতে ভদ্রলোকের জন্ম 1527 সালে ভারতে হয়, এরপর আকবরের সভা অলংকৃত করেন এবং 1620 সালে ওনার মৃত্যু হয় আর ওনাকে দাফন করা হয় মধ্যপ্রদেশের হান্ডিয়াতে। মাঝে 1582 সাল নাগাদ উনি কিছুদিনের জন্য ইরানেও ছিলেন। 
আসলে বাদশাহের নেক নজরে থাকার জন্য, তোষামোদীর উদ্দেশ্যে জাহাপনার ভোজনবিলাসীতাকে হাতিয়ার করে খাবারের পথটাই বেছে নিতেন, কারন সেটাই সরলতম রাস্তা। এভাবে কখনো কোনো রানী / বেগমরা, কখনো আমীর ওমরাহরা রান্না করতেন বাদশাহের জন্য - তবে খাবার সবার আগে খেতেন মীর ভাকওআল, তারপর বাদশাহ। দো-পেঁয়াজার অর্থ হল সাধারণ কথায় দুটো পেঁয়াজ হলেও যতটা মাংস তার দ্বিগুন পেঁয়াজ দেওয়া হয় বলেই নাকি এর নাম দো-পেঁয়াজা। আব্দুল মহিন ওরফে মোল্লা দো-পেঁয়াজা নাকি ভুল করে বেশি পিঁয়াজ দিয়ে ফেলেন, সেখান থেকেই ওই দো-পেঁয়াজা নামটি এসেছে।
এবার যদি বলি - এতক্ষন যা কিছু বললাম তার সবটাই মুখরোচক জনশ্রুতি। জানি একটু গোসা হবেন ঠিকই। কিন্তু বিখ্যাত গবেষক চৌধুরী মোহম্মদ নাঈমের মতে মমিন চরিত্রটি পুরোটাই কাল্পনিক - এর সাথে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে এভাবে খাবারের পদ নিয়ে সঠিক বিস্তৃত ইতিহাস কখনো সেভাবে লেখা হয় নি। রন্ধন প্রণালীর সাথে টুকিটাকি ইতিহাসের ছোঁয়া দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন অনেকেই। তাই আসল ইতিহাসের থেকে গালগল্পই বেশি চলে। এই জন্যই আমার কাজটি করার খুব ইচ্ছে। একটা অন্ততপক্ষে দলিল থাক যেখানে খাবারের প্রণালী নয়, ইতিহাস আর গল্প থাকবে - তাও নিজের মাতৃভাষায়। সেই কাজটি যতটা পারি করার চেষ্টা করছি। ভুলত্রুটি হলে শুধরে দেবেন, নতুন তথ্য হিসেবে জুড়ে নেব। যাই হোক, কাজের কথায় আসি। অনেকে বলেন আকবরের সভায় মোল্লা আকবর বা মোল্লা দো-পেঁয়াজা নামের কোনো সভাসদ ছিলেন না। পুরোটাই কাল্পনিক গালগল্প। আসলে এই দো-পেঁয়াজার উৎস হলো খোরাসান অঞ্চল, যা এখন ইরান আর আফগানিস্তানের মধ্যে বিস্তৃত। ছোট্ট করে জায়গাটা সম্পর্কে বলি, সাসানিয়ান রাজবংশের (224-651 AD) রাজারা পারস্যের এই Eastern Provience এর নাম দেন খোরাসান - যার অর্থ "যেখান থেকে সূর্য আসে"। এই অঞ্চলে রান্নার সময় দুই ধাপে পেঁয়াজ দেওয়া হয় বলেই এর নাম দো-পেঁয়াজা। এটি এমন এক পদ, যে যেমন খুশি খেতে পারে। মুরগি, ভেড়া, ছাগল, খাসী, উট, গরু, মহিষ থেকে শুরু করে ডিমেরও দো-পেঁয়াজা হয়। এই দো-পেঁয়াজাই এবারে মানুষের হাতে হাতে ঘুরতে ঘুরতে লখনৌ গিয়ে একরূপ নেয় আবার হায়দ্রাবাদ গিয়ে ওখানকার মশলাপাতি, আবহাওয়ার জন্য স্বাদে হালকা টক জুড়ে যায়। এটাই আবার যখন বাংলাদেশি আর পাঞ্জাবি রাঁধুনিদের হাত ধরে যখন বিলেত যায়, তখন তার ভোল আমূল পাল্টে যায়। এভাবেই জায়গার ভিত্তিতে, সেখানকার জলবায়ু, মশলার জন্য রান্নার পদগুলো কম বেশি পাল্টে যেতে থাকে। এখন আমরা বাজার চলতি রেঁস্তোরাতে যেটা খাই সেটাতে বেশি করে পেঁয়াজ দিয়ে কষিয়ে আচ্ছা করে তেল মশলা সহযোগে পরিবেশন করে লোকজনের চলে যাচ্ছে আর আমাদের জিভে ভালো ভালো জিনিস পড়ছে আমরাও আহা দারুন খেতে বলছি - আসলে আসল বলে আজ আর কিছু হয় না, মানুষের যেটা খেতে ভালো লাগে ওটাই চলবে বাজারে - আসল দিয়ে কি আর বাজার চলে! কে-ই বা এই আসল রন্ধন প্রণালীর প্রমাণপত্র নিয়ে বসে আছে। 

Comments

Post a Comment

Popular Posts