Vindaloo

 Pork Vindaloo - পর্তুগীজদের ছেড়ে যাওয়া একটুকরো ইতিহাস


ভিন্দালু নামটা প্রথম শুনি যখন আমার বয়েস ওই দশ-এগারো, ওই 1999/2000, ক্লাস সেভেনে পড়ি। পুরোনো দিনের গল্প তো, তাই একটু রসিয়ে বলি।  পড়াশুনা যাতে ভালো হয় তার জন্য বাড়িতে কেবল কানেকশন নেওয়া হয় নি। TVতে মাত্র তিনটে চ্যানেল, DD National - যেখানে শুক্রবার রাতে সাড়ে নয়টায় সিনেমা হত, বাচ্চাদের দেখার মত হলে ওই 11টা অবধি দেখার permisson পেতাম, শনিবার রাতে 10.30টায় সিনেমা দেখার কোনো প্রশ্নই ছিল না। ছিল DD Metro, যেখানে বিকেলে Duck Tales, Talespin cartoon দেখতাম। বিকেলে খেলাধুলো খুব একটা হতো না, 4টায় স্কুল ছুটি, বাড়ি আসতে আসতে সাড়ে চারটে পৌনে পাঁচটা। এবার বাড়ি এসে খেয়ে খেলতে গেলে টিমে জায়গা পেতাম না, পেলেও বল করতে দিত, ব্যাটিং পেতাম না। তার থেকে বাড়ি বসে cartoon দেখা ভালো বলে তাই-ই দেখতাম। আর ছিল DD Bangla চ্যানেল। কিছু ভালো বাংলা সিরিয়াল হতো তখন, দুপুরে সিনেমা, তার সাথে রান্নার প্রোগ্রাম এবং রবিবার রাতে 9টায় রঙ্গরস - খুব মাচা অনুষ্ঠান হলেও আর কোনো বিকল্প ছিল না আমার কাছে। ওই যেমন ঠিকঠাক নেতা না পাওয়ায় যাকে পারছে তাজেও নির্বাচিত করছে দেশের মানুষ - অনেকটা সেরকমই। সম্ভবত তখন গরমের ছুটি চলছিল - দুপুরবেলা রান্নার প্রোগ্রাম। এখনও আমি বাড়িতে নিরামিষ ঘ্যাট চচ্চড়ি হলে খাবারের চ্যানেলে খাবার দেখতে দেখতে খাই, এতে অখাদ্যগুলো গিলতে সুবিধা হয় বলে মনে করি। এই অভ্যাসের শুরুটা এই ছোটবেলা থেকে হয়েছে। যাই হোক সেদিনও কোনো অখাদ্যই খাচ্ছিলাম আর দেখছিলাম সেদিনের অতিথি শেফ সূর্যেন্দ্র কৃষ্ণ চক্রবর্তী। প্রথমে ওনার পরিচয় দেওয়া হলো, কোন কোন পাঁচতারা হোটেলে উনি কাজ করেছেন তারপর বিদেশে কোথায় কোথায় কাজ করেছেন সব বলার পর উনি বললেন আজ উনি গোয়ার একটি ডিস বানাবেন - নাম ভিন্দালু। পর্ক দিয়েই মূলতঃ রান্নাটি হয়, তবে উনি চিকেন দিয়ে ঘরোয়া ভাবে বানাবেন। ভিন্দালু নাম শুনেই মনে মনে সন্ধি বিচ্ছেদ করলাম। ভিন্দালু, মানে ভিন যুক্ত আলু - অর্থাৎ ভিনদেশী আলু , তারপর দেখলাম এইখানে আলু থাকে না। তখন বুঝলাম ওটা বিন্দালু হবে, বিনা আলুর মাংস। প্রথমবার ক্যামেরার সামনে তো, তাই ঘাবড়ে গিয়ে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। ছোটবেলার খেয়াল - যেমন পারতাম মনে মনে গল্প বানিয়ে নিতাম। তো পুরো রান্না দেখলাম, খুব সহজ পদ্ধতি, একদম মুখস্থ। মা সাথে দেখছিলেন, সোজা রান্না দেখে বাড়িতে মাঝে মধ্যেই হতে থাকলো চিকেন ভিন্দালু, স্পেশালি বাড়িতে কোনো অতিথি এলে চোখ বন্ধ করে মা আজও চিকেন ভিন্দালু রান্না করে আর অতিথি না এলে আজকাল ভিন্দালুতে আলু গুঁজে পরিমান বাড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে পরের দিনও একটুকরো মাংসের সাথে দুটো আলু দিয়ে চারটে পাউরুটির সাথে সকালের টিফিন হয়ে যায়। বাসি মাংসের স্বাদই আলাদা হয়। 

ছোটবেলার কথা অনেক হলো, এবারে বড় বেলায় আসা যাক। জ্ঞান বয়েসে ঠিকঠাক পর্ক ভিন্দালু খেয়েছি Dionne Alexander এর হাতে Bow Barrack Fest এ। সেখানে সমস্যা ছিল একটাই, সন্ধ্যের পরে যেতাম আর উনি রান্না করে দোকান দিতেন দুপুরের পর থেকে। তাই গিয়ে ঠান্ডা ভিন্দালুই কপালে জুটতো। ঠান্ডার সময় ঠান্ডা ভিন্দালু সত্যি বলতে ঠিক জমতো না, তবে বাড়িতে নিয়ে এসে গরম করে ভাত দিয়ে খেতে অভূতপূর্ব লাগতো। এরপর ভালো ভিন্দালু খাই Cafe Porkotini-তে। গোয়া ঘুরতে যাওয়া নিয়ে দুর্বলতা না থাকলেও গোয়ার স্বাধীনতার ইতিহাস পড়ার পর গোয়া সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম। 1947 সালে ভারত স্বাধীন হলেও গোয়া পরাধীন ছিল, এই জায়গা থেকেই গোয়া, গোয়ার মানুষ, খাবার দাবার, সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহ জন্মায়। তখনই এই ভিন্দালু সম্পর্কে আরেকটু ভালো করে জানি। চলুন তাহলে একটু ভিন্দালুর ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি করা যাক।

ভিন্দালু হলো গোয়ার ক্যাথলিক কমিউনিটির ট্রাডিশনাল খাবার। তবে ভিন্দালুর জন্ম গোয়াতে হয় নি, হয়েছে আরো 5500 মাইল পশ্চিমে আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর পশ্চিম উপকূলে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে পর্তুগালের শাসনাধীন চারটে দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি দ্বীপপুঞ্জ Madeira-তে যার রাজধানীর নাম Funchal। দ্বীপপুঞ্জটি পর্তুগালের থেকে প্রায় 600মাইল দূরে অবস্থিত। এই Madeira বিখ্যাত তার wine এর জন্য। 1411 থেকে পর্তুগীজরা এই দ্বীপপুঞ্জটিকে নিজেদের অধীনে রেখেছে। 
মাছ মাংসকে অনেক দিন ধরে সংরক্ষণ করার জন্য Madeira-র অধিবাসীরা একটি নিজস্ব পদ্ধতি ব্যবহার করতেন যার নাম Carne de Vinha d’alhos এবং অর্থ wine এবং রসুনে ডোবানো মাংস। মাংসটাকে ভিনিগার, লবন আর রসুনের ব্রোথে ডুবিয়ে রাখা হয়, আর ফ্লেভার বাড়ানো ও অনেক দিন রেখে দেবার জন্য ব্যবহার করা হত সেই বিখ্যাত Madeira wine। 1498 সালে ভাস্কো দা গামা কালিকট বন্দরে আসলেও ভিন্দালু কিন্তু নানা দেশ ঘুরে নিয়ে তার প্রায় একশ বছর পর ভারতে আসে। পর্তুগীজদের আধিপত্য ভারতের থেকে বেশি ছিল আমেরিকায়, তো সেই হিসেবে Carne Vinha d'alhos পদ্ধতি যখন ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বেরোলেন প্রথমে গেলেন আমেরিকার দিকে। খাবার migrate হলে একটা জিনিস খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে - খাবারের উৎস স্থল থেকে গন্তব্যে যাবার পর সেই এলাকার মাংস, মসলা প্রভৃতি জিনিস ওই খাবারের সাথে যুক্ত হয়ে নতুন ভাবে ওই এলাকার মানুষের খাওয়ার মত করে খাবারটির বিবর্তন হয়। সেই নিয়ম অনুসারে আমেরিকা (মূলতঃ দক্ষিণ ভাগই বলবো) গিয়ে Oregano আর Paprika-র সংযোজন হয়ে নাম হয় Vinyoo dalyge। 
Vinha d’alhos পর্তুগীজ নাবিকদের হাত ধরে ব্রাজিল থেকে ভারতে আসে ষোড়শ শতকে। এখানে ব্যাপারটা বেশ মজার, জন্ম পর্তুগাল অধিকৃত একটি দ্বীপপুঞ্জে, সেখান থেকে ব্রাজিল হয়ে (বলা বাহুল্য ব্রাজিলে খানিকটা বিবর্তিত হয়ে) ভারতের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলে এসে নাম নেই Vindaloo। পর্তুগীজ জাহাজিরা ভারতের মাটিতে পা রেখে বুঝতে পারলেন এখানে ভিনিগারের কোনো অস্তিত্ব নেই। Lizzie Collingham তার Curry: A Tale of Cooks & Conquerors বইয়ে লেখেন, কয়েকজন ফ্রান্সিসকান পাদ্রী নারকেল আর তালের তাড়ি দিয়ে ভিনিগার বানানোর চেষ্টা করেন। এই জন্যই গোয়ার ক্যাথলিকদের মধ্যে এই ভিন্দালু বেশি জনপ্রিয় হয় শুরুর দিকে। যাই হোক, এই তাড়িতে চিনির পরিমান অনেক, এটা মূলতঃ আসে গাছের জাইলেম আর ফ্লোয়েমের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া জল, খনিজ দ্রব্যের মধ্যে দিয়ে, যাকে Sap বলা হয়ে থাকে। এর সাথে ওনারা তেঁতুল আর রসুনও যোগ করে যে ফাইনাল আউটপুট পান সেটাতে ওই পাদ্রীরা বেশ খুশি, আসল জিনিস না পেলেও আসলের কাছাকাছি একটা জায়গায় তারা পৌঁছতে পেরেছেন। খাবারের migration এর ধর্ম অনুযায়ী এখানেও যোগ হল স্থানীয় মশলা - গোলমরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ লাল লঙ্কা। 
1500 শতকে Columbian Food Exchange এর মাধ্যমে আলু, টমেটো, ভুট্টার সাথে এই লাল লঙ্কা ভারতে আসে। লাল লঙ্কার যখন কথাই উঠল, তখন এটা নিয়ে একটু বলে নি। লাল লঙ্কা ভারতে আসার আগে পশ্চিমঘাট ও মালাবার উপকূলের জঙ্গলে Long pepper বা পিপলি নামের একরকম ফুল পাওয়া যেত, যেটা বেশ ঝাল ছিল। ওই পিপলি দিয়েই রান্নাই ঝালের কাজ চলত। তারপর পর্তুগীজরা লাল লঙ্কা নিয়ে আসার পর গোয়ার লোকজন দেখলো এটি চাষ করা বেশ সহজ এবং স্বাদের দিক থেকেও পিপলির মত বা তার কাছাকাছি তাই সারা দেশেই গোয়াই মিরচি নামে জনপ্রিয় হয়ে আজ সবার রান্না ঘরে। 
ভারতবর্ষ পরাধীন হবার অনেক আগেই ভিন্দালুর প্রচলন হলেও ব্রিটিশদের প্লেটে ভিন্দালু পৌঁছয় আরো দুশো বছর পর। ইংরেজরা চট্টগ্রামের মগ আর গোয়ার রাধুনিদের বেশি পছন্দ করত, কারন শুয়োর, গরু রান্না করার ক্ষেত্রে ওদের ধর্মের বাধা ছিল না, সবই রান্না করতে পারত তারা। 1888 সালে লন্ডনে প্রকাশিত Wife’s Help to Indian Cookery’ বইয়ে প্রথম ভিন্দালুর উল্লেখ পাওয়া যায় - যেখানে ভিন্দালুকে বর্ণনা করা হয় পর্তুগীজ কারি হিসেবে। 1970 সাল নাগাদ যখন ব্রিটেনে প্রচুর ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ খুলে যায় তখনই এর জনপ্রিয়তা বাড়ে। তবে ওখানে বেশিরভাগ বাংলাদেশি রাধুনিরা রান্না করে বলে ভারতের ভিন্দালুর সাথে অনেকটাই তফাৎ হতে হতে সেটা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে গেছে মেনুর সবথেকে ঝাল ডিসে। ভিনিগারের টক এখানে উধাও, মাংসের ম্যারিনেশন হয় এখানে অন্যভাবে, লঙ্কার ঝালের আধিক্যের জন্য বাকি অন্য মশলার স্বাদ কেন গন্ধও এখানে পাওয়া যায় না। ইংরেজরা নিজেদের হনু প্রমান করার জন্য ভিন্দালু অর্ডার দিয়ে থাকে রেস্তোরাঁগুলোতে - লোকজনকে দেখানো, দেখো আমার কত ক্ষমতা, আমি কত ঝাল খেতে পারি। 1998 এর football worldcup এ england দলের unofficial football anthem ছিল,  ‘Vindaloo-Vindaloo-Vindaloo, we’re gonna score one more than you.’ । এর থেকে বোঝাই যায়, ঝাল হওয়া সত্ত্বেও ভিন্দালুর জনপ্রিয়তা কিন্তু বিলেতে কম নয়।

You can order Pork Vindaloo from Cafe Porkotini. Here is the details
Café Porkotini
90, Kalitala Rd, North Purbachal, Haltu, Kolkata, West Bengal 700078


Courtesy: 
Lizzie Collingham
Live History India 

Comments

Popular Posts