Ganpati Bappa & Modak

মোদকপ্রিয় গনপতি বাপ্পা 

image courtesy: pinterest.com

মহারাষ্ট্রের গনপতি বাপ্পার সাথে মোদকের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই মোদকের ইতিহাস ঠিক বলব না, বরং বলবো অনেক পৌরাণিক কাহিনী আছে। তার আগে হিন্দু ধর্মের কিছু দেবদেবীদের খাবার এবং জীবনশৈলী সম্পর্কে যদি একটু আলোচনা করা হয়, তাহলে ব্যাপারটা আপনাদের কাছে বুঝতে আরও সুবিধা হবে। আমাদের হিন্দু ধর্ম বা শাস্ত্রে খাবারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। হিন্দু ধর্মে খাবার এবং প্রসাদের প্রকারভেদ দেবতাদের জীবনশৈলীর ওপর নির্ভর করে বানানো হয়েছে। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে আপনাদের একটু বুঝিয়ে বলি। শুরু করা যাক দেবাদিদেব মহাদেব কে নিয়ে, মহাদেব একজন যোগী - উনি শ্মশানেই থাকেন, তাই প্রসাদ বা মধ্যে বেশির ভাগটাই গোটা ফল যেমন বেল, ধুতুরা ফল ইত্যাদি। মায়ের সাথে যখন শিবরাত্রিতে শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য যেতাম, সেই সময় দেখতাম কাকিমা পিসিমা জেঠিমারা শিবের মাথায় জল ঢেলে গোটা শাকালু, গোটা শসা, গোটা কলা ইত্যাদি নিবেদন করছেন। কিন্তু লক্ষ্মীপূজো, সরস্বতী পুজো ইত্যাদি ঘরোয়া পুজোতে আমরা কিন্তু ফলগুলোর খোসা ছাড়িয়ে কেটে পুজোতে নৈবেদ্য হিসাবে দিয়ে থাকি। এরপরে যদি ভগবান শ্রী বিষ্ণু কে নিয়ে বলি, তাহলে বলব উনি একজন সংসারী মানুষ, তাই জন্য ওনার প্রসাদ বা খাবারের বেশির ভাগটাই হয় রান্না করা খাবার। এবারে একটু লক্ষ্মী আর অলক্ষ্মীর গল্প বলি, লক্ষ্মী হল শান্ত আর অলক্ষী হল দুরন্ত, লক্ষীর অধিষ্ঠান ঘরের ভিতরে এবং লক্ষ্মীর ভোগে আমরা কাটা ফল থেকে শুরু করে রান্না করা খাবার যেমন খিচুড়ি আলুরদম ইত্যাদি দিয়ে থাকি। অলক্ষী হলো ডানপিটে, আম গাছে উঠে আমি পেড়ে খেয়ে নিল, তেঁতুল গাছে উঠে তেঁতুল পেড়ে নিয়ে নুন মাখিয়ে খেয়ে নিল। এইজন্য অলক্ষ্মীর প্রসাদ হল লেবু লঙ্কা, যেটা সব হিন্দু বাড়ি বা দোকানের বাইরে ঝুলানো থাকে। এর অর্থ হল অলক্ষী তুমি বাইরে থাকো ভিতরে ঢুকো না, তোমার খাবার লেবু লঙ্কা দরজার বাইরে রাখা আছে। এটা তো গেল প্রসাদের কথা, হিন্দুধর্মে কিন্তু খাবার খাওয়ারও একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। উদাহরণ হিসেবে যদি আমরা কৃষ্ণের ছাপ্পান্ন ভোগের কথা বলি, সেখানে গল্পটা এইরকম যে, বৃন্দাবনের অধিবাসীরা প্রতি বছর দেবরাজ ইন্দ্রের পুজো করতো এবং দেবরাজ ইন্দ্র খুশি হয়ে বৃষ্টি দিত যার ফলে তারা চাষবাস করতে পারত। এখন বালকৃষ্ণর লীলাতে সমস্ত বৃন্দাবন বাসীরা মোহিত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের পূজোর কথা ভুলেই গেলেন, সেই রাগে দেবরাজ প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটালেন টানা সাতদিন ধরে, যার ফলে প্রবল বন্যা হয় বৃন্দাবনে। তখন এই বালকৃষ্ণ বৃন্দাবনবাসীদের পরিত্রাতা হয়ে গোবর্ধন পর্বত কে আঙ্গুলের ওপরে তুলে নিয়ে তার তলায় সমস্ত মানুষকে আশ্রয় দিয়ে তাদের রক্ষা করেন। টানা সাত দিন কিছু না খেয়ে কৃষ্ণ গোবর্ধন পর্বতকে ধরে রেখেছিলেন। আমরা জানি একেকটা দিন মানে আটটা প্রহর অর্থাৎ তিন ঘন্টায় একটা প্রহর হয়। সাত দিনের আটটা প্রহর, মানে কৃষ্ণ মোট ছাপ্পান্নবার খাবার খাননি। এইজন্য বৃন্দাবন বাসীরা প্রলয় কেটে যাবার পরে তাকে ছাপ্পান্ন রকমের খাবার খাইয়েছিলেন। এটাতো গেল পৌরাণিক কাহিনী, এবারে একটু বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনায় আসা যাক। আমি কম্পিউটার সাইন্সের ছাত্র, বায়োলজি বা মেডিকেল সাইন্সের খুব একটা জ্ঞান নেই। সাধারণ জ্ঞান এবং কিছুটা কথা শুনে লেখাটা লিখছি ভুল হলে শুধরে দেবেন। এখন ডাক্তারবাবুরা প্রায়ই বলেন বেশিক্ষণ খাবার না খেয়ে থাকবেন না, দুই-তিন ঘন্টা পরপরই অল্প কিছু হলেও পেটের মধ্যে কিছু কিছু খাবার দিতে থাকুন। অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে আপনার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে গলব্লাডারে পাথর পর্যন্ত হতে পারে। তাহলে বোঝা গেল তো আমাদের প্রহরে প্রহরে খাবার খাওয়ার রীতি কোথা থেকে এসেছে এবং এটি কেন দরকারি। 
image courtesy: mixingimage.com

হিন্দু শাস্ত্রে এরকম আরো অনেক গল্প আছে, বাকি গল্পগুলো অন্য কোন সময় হবে। আমরা চলে আসি আমাদের মূল আলোচনায় যেটা হলো গণপতি বাপ্পা এবং তার সাথে মোদকের সম্পর্ক। গণপতি পূজা শুরু করেন ছত্রপতি শিবাজী মোগলদের বিরুদ্ধে মারাঠাদের একত্রিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে, সেখানে জাতীয়তাবাদ একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল। এরপর লোকমান্য তিলক স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই পুজোটা মারাঠীদের ঘরে ঘরে ঢুকিয়ে দেন। চলতি কথায় বলতে গেলে এই পুজোটিকে গৃহস্থের ঘরে ঢোকানোর পিছনে ওনার উদ্দেশ্য ছিল, ব্রাহ্মণ এবং অব্রাহ্মণ মানুষদের মধ্যে দূরত্ব ঘোচানো। মহারাষ্ট্রে এই বর্ণভেদের কুপ্রথাটি আজও বিদ্যমান, লোকমান্য তিলক যা দূর করতে চেয়েছিলেন। এইজন্যই কিন্তু কিছু পুজো বাদ দিলে মহারাষ্ট্রের মোটামুটি সমস্ত পুজোয় মারাঠিরা গনপতির আরতি নিজেরাই করেন, ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত ছাড়া। 
গুড়ের সন্দেশ মোদক 

মোদক শুধু মারাঠীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তেলেগুরা মোদককে মোদকম বা কুদুমু বলে, কাদুবু বা মোধকা বলে কন্নড় লোকেরা, মালায়ালীদের কাছে এটি কঝুককাট্টা আর তামিলদের কাছে কঝুককাট্টাই নামে পরিচিত। মারাঠিতে মোদকের অর্থ হল খুশি বা আনন্দ। গনপতিও সবসময় হাসিখুশি থাকেন, তাই ওনার মোদক খুব পছন্দের। এর সাথে গনপতিকে বুদ্ধি ও জ্ঞানের দেবতা মানা হয় এবং মোদককে জ্ঞানের ও বুদ্ধির প্রতীক মনে করা হয়। এসব কিছু লজিক দিয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার করে গনপতির সাথে মোদকের একটা সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে হয়েছে বহুকাল ধরেই। কিন্তু আসল গল্পগুলো পুরান ঘাটলে পাওয়া যায়। প্রথম গল্পটা যেটা বলছি সেটা - পদ্ম পুরান অনুসারে, দেবতারা একবার অমৃত দিয়ে মোদক বানিয়ে মা পার্বতীকে দিয়েছিলেন। মা সেই মোদকগুলো কার্তিক ও গণেশের মধ্যে ভাগ করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দুই ভাইয়ের কেউই সেই মোদক ভাগ করতে রাজি নন। দুই ভাইয়েরই সবটা চাই। মা পার্বতী পড়লেন মহা মুশকিলে। তখন তিনি বুদ্ধি খাটিয়ে পরীক্ষার কথা ভাবলেন এবং তার দুই ছেলেকে বললেন, দুজনের মধ্যে যে পুরো ব্রহ্মান্ড সবার আগে ভ্রমন করে আসবে সেই-ই পাবে এই অমৃত দিয়ে বানানো মোদকগুলো। এই শোনামাত্রই কার্তিক বেরিয়ে পড়লো ময়ূূূর নিয়ে সারা ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমণ করতে আর গণেশ শিব এবং পার্বতীর চারপাশে ঘুরে তাদের প্রণাম করলেন। এটা দেখে মা পার্বতী বড়ই প্রসন্ন হলেন এবং সমস্ত মোদক গণেশের হাতেই তুলে দিলেন। তখন থেকেই গণেশের সামনে মোদকের ভোগ দেবার রীতি শুরু হয়। 
স্ট্রবেরি সাদা সন্দেশ মোদক

এবারে আরো একটা গল্প বলি, একবার পরশুরামের সাথে গণেশের যুদ্ধ হয় যেখানে গণেশের একটা দাঁত ভেঙে যায়, এই ভাঙা দাঁতের জন্যই ওনাকে বক্রতুন্ড বলা হয়। ভাঙ্গা দাঁতের জন্য গণেশের খাবার খেতে খুব সমস্যা হচ্ছিল, তখন ওনাকে মোদক খেতে দেওয়া হয়। মোদক নরম বলে ওনার খেতে খুব সুবিধা হয়। তারপরই থেকেই গণেশের ভোগে মোদক চালু হয়। 
চকলেট সাদা সন্দেশ মোদক 

এবারে আসি আমার তৃতীয় ছোটগল্পে, ঋষি অত্রির স্ত্রী অনুসূয়া একবার পার্বতী এবং গণেশকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান এবং তাদের কাছ থেকে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে শিব পার্বতী এবং গণেশ অনুসূয়ার বাড়িতে হাজির হন যেখানে অনুসূয়া তাদের খাবারের আয়োজন করেন। শিব পার্বতীর সাথে গণেশকেও খাবার দেওয়া হয়, কিন্তু প্রচুর খাবার খেয়ে নেওয়ার পরেও গণেশের পেট ভরে না। এই অবস্থায় শিব সেই ঘটনাটা লক্ষ্য করেন, কিন্তু নিজে ক্ষুধার্ত থাকায় গনেশকে কিছু বলেননি বরং নিজের খাবারেই মনোনিবেশ করেন। এই অবস্থায় অনুসূয়া গনেশকে মিষ্টি হিসাবে মোদক খেতে দেন এবং সেই মোদক খেয়েই তার পেট ভরে যায় আর সেটা তিনি ঢেঁকুর তুলে অনুসূয়াকে বুঝিয়ে দেন। শিব এবং গণেশ দুজনেই খাবারে তৃপ্তি পেয়েছিলেন এবং দুজনেই একুশবার করে ঢেঁকুর তোলেন। এই ঘটনায় মা পার্বতী আশ্চর্য হয়ে যান এবং অনুসূয়ার কাছ থেকে মোদক বানানো শেখেন। মনে করা হয় এই কারণের জন্যই গণেশের মোদক ভোগে একুশটি করে মোদক থাকে। 
একুশ মোদকের নৈবেদ্য 

মোদকের পৌরাণিক কথা নিয়ে তো অনেক কথাই বললাম, এবার আসি কি কি দিয়ে বানানো হয় এবং পৌষ্টিক উপকারিতা নিয়ে, কেন মোদক আমাদের খাওয়া উচিত! মোদক প্রধানত বানানো হয় চালের গুঁড়ো, ময়দা, নারকেল এবং গুড় দিয়ে। মোদককে ভাপানো হয় আবার ভাজাও হয়। ভাপানো মোদককে বলা হয় - উখড়িচে মোদক, এর ওপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় গরম ঘি। আর ভাজা মোদককে বলা হয় তালালেলে মোদক।  মোদকে নারকেল থাকার জন্য এটা সহজপাচ্য, শরীরের মেটাবলিজম বাড়াতে সহায়তা করে, শরীরে গুড কোলেস্টেরলকে ( HDL - High Density Lipoprotein) বাড়ায় এবং বর্ষার সময় শরীরে যে ব্যাকটেরিয়াগুলো থাকে তার বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। গুড় সাহায্য করে সর্দি ও কাশির বিরুদ্ধে লড়ার জন্য। এছাড়া লিভার detoxification এর জন্যও গুড় খুব উপকারী। মোদককে যেহেতু ভাপানো হয় তাই জন্যে ওর মধ্যে 90% অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থেকে যায়, খাবারের রঙ থেকে শুরু করে টেক্সচার, ফ্লেভার সমস্ত কিছু প্রায় একই রকম থাকে। এইজন্যই মোদক শরীরের জন্য এত উপকারী। 
সাদা সন্দেশের মোদক 

এখন বলি আমি এই মোদক গুলো কথা থেকে পেলাম। কলকাতায় প্রকৃত মোদক পাওয়া সত্যিই বড় কষ্টের ব্যাপার। সবাইতো বানায়ই না, আর বানালেও কোয়ান্টিটি খুবই কম। এই ক্ষেত্রে মোদকের সন্দেশ দিয়ে আমাদের কাজ চালাতে হয়। 
আমিও কালীঘাট মন্দিরের কাছে আদি শ্রী হরি মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে মোদকের সন্দেশ নিয়ে আসি। ওরা আমাকে সাত রকমের মোদকের সন্দেশ দেয়। তারমধ্যে চকলেট স্ট্রবেরি কেশর কাঁচা আম পাকা আম ইত্যাদি নতুনত্ব এনেছেন। ছানার সন্দেশের মধ্যে ফ্লেভার এবং রং দেওয়া। খেতে মন্দ লাগে না কিন্তু। 

কাচা আম মোদক 
পাকা আম মোদক 


Adi Sree Hari Mistanna Bhandar
25A, Kali Temple Rd, Kalighat, Kolkata, West Bengal 700026
72788 01469


কেশর মোদক সন্দেশ 

Comments

Popular Posts