গরমের কলকাতার রাস্তায় ঠান্ডার পরশ

কলকাতার গরম এর মধ্যেই চল্লিশ ছুঁয়ে ফেলেছে। কাজের জন্য আমরা, যারা রোজ রাস্তায় বেরোই, বা যাদের কারনে-অকারনে, বিনা কারনে রাস্তায় বেরোতে হয়, তাদের এই চাঁদি ফাটা গরমে একটাই বাঁচার উপায় - ঘন ঘন জল খাওয়া। এত গরমে বাড়ি থেকে সাথে নিয়ে যাওয়া জলও কিছুক্ষণের মধ্যে এতটা গরম হয়ে যায় যেন মুখে গেলে মুখ পুড়ে যাবে। এই গরমে তখন রাস্তার ধারে বরফ দেওয়া পাতিলেবুর শরবত যেন ধরে প্রাণ ফেরায়। 

এই গরমে হঠাৎ শরবত খাওয়ার সংকল্প নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম একদিন দুপুরে। উদ্দেশ্য ছিল কলকাতার সেরার সেরা শরবতের দোকানগুলো থেকে শরবত খাবো। যাত্রা শুরু হল কলেজ স্ট্রিট থেকে শেষ হল কিড স্ট্রিটে। শুরু করা যাক এক এক করে। 
1. Paramount: গরমকালে কলেজস্ট্রিটে কেউ যদি বই কিনতে যায়, তাহলে আমরা একটা বাজি ধরতে পারি তাকে নিয়ে। সে বই কেনার আগে প্যারামাউন্টের শরবত খাবে! না বই কিনে শরবত খাবে। এই শরবত খাওয়ার শুরুটা 1918 সাল থেকে। তখন নাম ছিল প্যারাডাইস। পরে নাম বদলে হয় প্যারামাউন্ট। এই শতাব্দী প্রাচীন শরবতের দোকানে বহু প্রজন্মের মানুষ এসে শরবত খেয়ে গেছেন। প্যারামাউন্টে গেলে সেই নামের লিস্ট পড়লে সেই আন্দাজ পাওয়া যায়। এই প্যারামাউন্ট সাক্ষী আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের।  1918, এই সময়ে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের দর্শনের ছাত্র। তখন থেকেই তার এখানে আশা যাওয়া লেগে থাকতো, তবে শরবত খেতে নয়। বিখ্যাত অনুশীলন সমিতির কাজের জন্য। সামনে চলত শরবতের দোকান আর পেছনে চলত বৈপ্লবিক কর্মকান্ড। মাঝখানে ব্রিটিশরা এই দোকান বন্ধ করে দেয়, পরে আবার শুরু হয়। প্যারামাউন্টকে আমরা মূলতঃ চিনি তার ডাব শরবতের জন্য। এই ডাব শরবতেরও একটা বড় ইতিহাস আছে। এই ডাব শরবতের ফর্মুলা কিন্তু বানিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। প্যারামাউন্টের প্রতিষ্ঠাতা নীহাররঞ্জন মজুমদারকে তিনি বলেছিলেন এমন এক শরবত বানাতে যা খেলে লোকের পেটও ভরবে আবার তৃষ্ণাও মিটবে। তারপরই তিনি নিজে এই ডাবের শরবতের রেসিপি নীহাররঞ্জন বাবুকে দেন আর সেই থেকে প্যারামাউন্টের ডাবের শরবত আজও চলছে। 
2. Kapila Ashram: কলেজস্ট্রিটে প্যারামাউন্টের শরবত খাওয়া শেষ হলে বিধান সরণি ধরে হাতিবাগানের দিকে হাটতে থাকলে বিদ্যাসাগর কলেজ পেরিয়ে শ্রীমানি মার্কেটের কাছেই 202 বিধান সরণিতে আছে আমাদের কলকাতার সব থেকে পুরোনো শরবতের দোকান কপিলা আশ্রম। 1907 সালে হৃষিকেশ শ্রীমানি প্রতিষ্ঠা করেন কপিলা আশ্রম। বর্তমানে একটা গুজব রটেছে, কপিলা আশ্রম নাকি বন্ধ হয়ে গেছে। রটনাটি সত্যি নয়, ওনারা যে ভগ্নপ্রায় বাড়িতে শরবত বিক্রি করতেন সেটা ভাঙা হয়েছে নতুন করে বানাবে বলে, ততদিন ওনারা ফুটপাথেই শরবত বিক্রি করছেন। আপাতত খালি কাঁচা আমের শরবত পাওয়া যাচ্ছে ওখানে, তবে শীঘ্রই ওনারা ঘোল, আনারসের শরবত, আবার খাবো শুরু করবেন বলে জানালেন।
3. Shivashram: কপিলা আশ্রম থেকে শরবত খেয়ে আরেকটু এগিয়ে আসলে একই রাস্তায়, 168 বিধান সরণিতে আছে চল্লিশ বছরের পুরোনো শিবাশ্রম। শিবাশ্রম বিখ্যাত তার ভাঙের জন্য। এছাড়াও আছে বিভিন্ন রকম ফ্লেভারের লস্যি।
4.  Five Point Juice Centre: শিবাশ্রমে ফ্লেভারড লস্যি শেষ করে এবারে বাস নিয়ে এসে নামতে হবে শ্যামবাজার মোড়ে। এখানে নেমে বা দিকে একটু হাঁটলেই পড়বে five point juice centre। বিখ্যাত তার পাকা আমের শরবতের জন্য। আমসত্ত্ব আমের সাথে খোয়াক্ষীর, কাজু, কিশমিশ, চেরী দিয়ে সাজিয়ে অসাধারণ এক পরিবেশনা তাদের।
5. Ralli's: বিখ্যাত ব্লগার শ্রী ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ী মহাশয়ের লেখা বই ফুডকাহিনী পড়ে জানতে পারি 1918 সালে Ralli Singh Arora-র হাত ধরে শুরু হয় পাঞ্জাব শরবত হাউস, যা আজকে Ralli's নামে বিখ্যাত। কলকাতার বুকে বর্তমানে তাদের চারটে আউটলেট আছে। গোলপার্ক, এসপ্লানেড, কৈখালী এবং বাঙ্গুরে। শ্যামবাজার থেকে টুক করে মেট্রো ধরে এসপ্লানেড নেমে 4নং গেট দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকে পঞ্চাশ মিটার হাঁটলেই পরে ralli's।
6. Sip n Drink: ধর্মতলা গেলে আমি যে অধর্মের কাজটা করবোই, সেটা হলো K.C. Das এর পেছনে Sip n Drink থেকে আমের শরবত কিনে ছবি তুলে খেয়ে তারপর সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা। ralli's এ শরবত খেতে এসেছি, আর sip n drink এ শরবত না খেয়ে যাবো, এমনটা আবার কখনো হয় নাকি। কোনো রকম ভেজাল ছাড়া খাঁটি আম দিয়ে বানানো আমের শরবত গরমের সময় যেন অমৃত। শুধু গরম কেন, শীতকালে আপনি যদি হঠাৎ মাঝরাতে স্বপ্ন দেখেন আপনার আম খাচ্ছেন এবং ঘুম থেকে উঠে আমের স্পৃহার জন্য আপনি কাজে মন বসাতে পারছেন না, তাহলে নির্দ্বিধায় চলে আসুন এখানে। বারো মাস এখানে আমের শরবত পাওয়া যায়। 
7.  Kyd Street এর আখের রস : দুপুর 1টা নাগাদ বেরিয়েছিলাম শরবত খেতে, কলেজস্ট্রিট থেকে শ্যামবাজার হয়ে এসপ্লানেডে শরবত খেয়ে বেলা তখন গড়িয়ে গেছে, সূর্যের তেজও আর সেরকম নেই। এরকম সময় মনে পড়ল আরেকটা জায়গা বাকি থেকে গেছে। kyd streetএ mancherji's এ যখন পার্সী খাবার খেতে যেতাম ওখানে MLA hostel এর আগেই ডানহাতে দেখেছিলাম আখের রস বিক্রি করতে। এখানে আখের রস কিন্তু স্বাদের জন্য আমাকে টানে নি, আর পাঁচটা সাধারণ আখের রসের মটন এটাও। আমাকে টেনেছে এদের জাম্বো সাইজের গ্লাসটা। 30টাকায় এক গ্লাস ভরে যা দেয়, খাবার পরই মনটা গেয়ে ওঠে 
मैं रंग शर्बतों का
तू मीठे घाट का पानी
मुझे खुद में घोल दे तो
मेरे यार बात बन जानी
যেই ভাবা ওমনি কাজ, এসপ্লানেড থেকে মেট্রো ধরে পার্কস্ট্রিট নেমে 3নং গেট দিয়ে বেরিয়ে পার্কস্ট্রিট ক্রসিং পেরিয়ে জাদুঘরের দিকে হাটা লাগাতেই প্রথম ডান দিকের গলি, ওটাই kyd street। 
8. Ashrafi Juice Centre: বেশ কয়েকদিন ধরে মেটিয়াবুরুজ ঘুরছি, কলম্বাসের মত নতুন কিছু খোঁজার আশায়। তফাৎ একটাই, কলম্বাসের ছিল দেশ খোঁজার নেশা আর আমার আছে অজানা জায়গায় খাবার খোঁজার নেশা। মেটিয়াবুরুজ ঘুরতে গিয়ে মেটিয়াবুরুজ হাটের কাছে আবিষ্কার করি এই দোকানটিকে। তিন ধরনের শরবত খাই এখানে। প্রথমটা অতি সাধারণ আমসত্ত্ব দেওয়া আমের শরবত, যা আমার sip n drink এবং Five Point Juice Centre এ খাওয়া। মেটিয়াবুরুজ আমাকে নিরাশ করে নি। এরপর একদম খাঁটি আমের শরবতের ওপর vanilla icecream দিয়ে শরবত। একটা স্বর্গীয় ব্যাপার তৈরি হয়েছিল মশাই খাওয়ার সময় যা ভাষায় প্রকাশ করা খুব কষ্টকর। এর থেকে অনেক সহজকাজ মেটিয়াবুরুজ গিয়ে এই খাঁটি আমের শরবত খেয়ে আসা। এরপর খাই আরো একরকম শরবত। আমরা ফালুদা, রু-আফজা সহযোগে কুলফি রাসবিহারীর bachhan's ধাবার সামনে হামেশাই খেয়ে থাকি। কিন্তু কুলফি ফালুদা দিয়ে শরবত বানানোর শৈল্পিক চিন্তাভাবনাকে বানানো দেখেই কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় ছিল না। 

এই ছিল আমার শহরে শরবত অভিযান। আপনাদের সাথে ভাগ করলাম। তবে আপনাদের থেকে আপনাদের প্রিয় শরবতের দোকানের নাম জানতে চাই, যেন কখনো কোনো রাস্তায় পিপাসা পেলে আমাকে মিনারেল ওয়াটারের বোতল কিনে খেতে না হয়। 😋😋😋😋

Comments

Post a Comment

Popular Posts