গয়নাবড়ির গপ্পকথা || The Story Behind Bengal's Artistic Delicacy - Goyna Bori

গয়নাবড়ি, বাংলার এক এমন শিল্প যার সাথে জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ, আছে ব্রিটিশ অত্যাচারের ইতিহাস... আছে গ্রামবাংলার মা ঠাকুমার দাঁতে দাঁত চেপে সংসার চালানোর কষ্টের গল্প। ভাবতে খুব অবাক লাগে আমাদের দেশে চপ, পাকোড়ার নতুন শিল্প হতে পারে কিন্তু কয়েকশো বছরের পুরনো এই শিল্পকে নিয়ে ভাবনাচিন্তার সময় কারোরই নেই।


শহরের বহুমানুষ হয়তো নামই শোনেন নি এই গোয়নাবড়ির অথচ বিশ্বকবি প্রথমবার এই গয়নাবড়ি দেখেই তার আলোকচিত্র কলাভবনে সংরক্ষণের ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। এই গয়নাবড়ই সম্পর্কে আমার স্বল্প জ্ঞান আপনাদের সাথে একটু ভাগ করছি, যদি কোথাও তথ্যের ভুল থাকলে শুধরে দেবেন, আরো নতুন জিনিস শিখতে পারবো। যাই হোক, বড়ি বর্তমানে বাংলার বহু জেলাতে হলেও শুরুটা হয়েছিল ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে, আরেকটু ভালো করে বললে অবিভক্ত মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম প্রভৃতি জেলায়। তবে গয়নাবড়ির জন্ম মেদিনীপুর বলেই দাবি করেন IIT Kharagpur এর প্রাক্তন ডিরেক্টর ডঃ পার্থ প্রতিম চক্রবর্তী (2013-2019), যার বদান্যতায় 2016 সালে গয়নাবড়ি GI tag পায়।


গয়নাবড়ির প্রধান উপকরণ হলো শীতকালে ওঠা খোসায়ালা বিউলির ডাল। যাকে মোটামুটি দশ বারোঘন্টা ভিজিয়ে নরম করে খোসা ছাড়িয়ে শিলে বেটে নেওয়া হয় মিহি করে। এরপর একে ফেটানো হয়, যত বেশি ফেটানো হয় তত হাওয়া এর ভেতরে ঢোকে আর বড়িও ততই মুচমুচে হয়। এরপর কুলো বা কাঁসার থালায় (এখন অনেকে স্টেইনলেস স্টিলের থালাও ব্যবহার করেন) অল্প তেল মাখিয়ে তার ওপর পোস্ত ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই পোস্ত ব্যবহারেরও আরেকটা গল্প আছে, সেটাও বলছি। এরপর ওই ফেটানো ডালকে কাপড়ের পুটলি বানিয়ে তার ভেতরে ভরে আল্পনা দেবার মত করে থালার ওপরে নকশা আঁকা হয়। মূলতঃ শীতকালেই বড়ি বানানো হয় কম রোদের তাপ এবং বাতাসে কম আপেক্ষিক আদ্রতার জন্য। বেশি রোদ পড়লে বড়ির ভেঙে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এমনিতে চালকুমড়ো, হিং বা মশলার বড়ি সাদা শাড়ির ওপর দিয়ে শোকানো হত, কিন্তু গয়না বড়ির ক্ষেত্রে যেহেতু নীচে পোস্ত থাকে তাই বাসনের ব্যবহার এখানে করতেই হয়। নকশা বানানো হয় শিল্পীর ইচ্ছে মত, কল্কা থেকে শুরু করে মুকুট, টিকলি, নেকলেস ইত্যাদি গয়নার আকারের করে থাকেন। গয়নার আকারের বানানো হয় বলেই একে গয়নাবড়ি বলা হয়। খেয়াল করলে দেখা যায়, ডোকড়ার গয়নার সাথে গয়নাবড়ির নকশার অনেক মিল পাওয়া যায়।

এবারে, পোস্তর কথায় আসা যাক। বাঙালী খাবারে পোস্ত এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু এই পোস্ত ইংরেজ আর চীনাদের ঝামেলা না হলে আমরা হয়তো এর অস্তিত্ব টেরই পেতাম না। ব্রিটিশরা বহুদিন ধরেই চীনের সাথে ব্যবসা করে আসছে, কিন্তু সেই ব্যবসা ছিল একতরফা। ব্রিটিশরা চীনাদের কাছ থেকে কিনত চা আর কাগজ এবং তার বদলে দিতে হত রৌপ্যামুদ্রা, কিন্তু তার বদলে ব্রিটিশদের কিছু বেচার ছিল না চীনাদের। সেই সময় চীনে আফিমের দাম ছিল খুব বেশি, তাই ব্যবহার ছিল সমাজের উচ্চবর্গের মানুষদের কাছে এবং বেশ কিছু সময়ে চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়েছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে রবার্ট ক্লাইভের হাতে সিরাজ উদ দৌলার পরাজয়ের পর বাংলা বিহার উড়িষ্যার সমস্ত ক্ষমতা পেয়ে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা চাষিদের বাধ্য করে আফিম চাষের জন্য। শুরু হয় সবজায়গায় অবাধে আফিম এবং নীলের চাষ, এরফলে বাজারে অন্য ফসলের ঘাটতি দেখা যায়, সবজির দাম বাড়ে যা সাধারণ চাষীদের পক্ষে কিনে খাওয়া বেশ কষ্টকর। চাষের শেষে আফিম নিষ্কাশনের পর চাষীদের বাড়ির উঠানে পড়ে থাকতো কেবল অসংখ্য পোস্ত ফুলের বীজ। বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, মেদিনীপুরের গরীব চাষিদের পরিবার সেই বীজ নিয়েই চেষ্টা করে যদি নতুন কিছু রান্না করা যায়। এইভাবেই বাঙালির রান্না ঘরে এসে পোস্ত। সেখান থেকেই আসে পোস্তর বড়া, ঝিঙে পোস্ত, পটল পোস্ত থেকে শুরু করে মাংসের মধ্যেও পোস্ত। আলু যখন সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য হলো, তখন বাঙালি পেল তার প্রানের আলুপোস্ত। তরকারির ঝোলকে পোস্ত দিয়ে আরেকটু গাঢ় করবার রীতি কিন্তু তখন থেকেই। বড়ির মধ্যে পোস্ত আসার গল্পটা একটু অন্যরকম - যখন গয়নাবড়ি বানানো হয় তখন নকশার জন্য বড়ির মধ্যে বিচিত্রতা আসলেও তা ভঙ্গুর হতো। কুলো, কাঁসার থাকার ওপরে পোস্ত ছড়িয়ে তার ওপর বড়ি দেবার ফলে একটু হলেও তা শক্ত হয়।


এবারে আসা যাক এই মহার্ঘ্য গয়নাবড়ি কে কোথায় কবে বানায় তার কথায়। ঐতিহাসিক ডঃ উৎসা রায়ের মতে মেদিনীপুরের তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটা, নন্দীগ্রাম প্রভৃতি গ্রামের মাহিষ্য মহিলারাই প্রথম গয়নাবড়ির প্রচলন শুরু করেন। সালটা 1930,  মহিষাদলের লখ্যা গ্রামের সেবা মাইতি বিশ্বভারতীর ছাত্রী ছিলেন, বিশ্বকবি তখন শান্তিনিকেতনেই। মা হিরণ্ময়ী দেবী ও ঠাকুরমা শরৎকুমার দেবীর বানানো গয়নাবড়ি উপহার দেন গুরুদেবকে। গুরুদেব গয়নাবড়ির কারুকার্য দেখে এতটাই অভিভূত হন যে, বড়ির ছবি তুলে তা কলাভবনের দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখার ইচ্ছা অবধি প্রকাশ করেন। সেখান থেকেই গয়নাবড়ির জনপ্রিয়তা শুরু। ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ তো এই বড়ি খাওয়াকে শিল্পকলা ধ্বংসের সাথে সমগোত্রীয় মনে করতেন। অবনীন্দ্রনাথের শিষ্য প্রখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসুর কথায়, গয়নাবড়ি হলো বঙ্গমাতার গয়নার বাক্সের এক অমুল্যরতন। তিনি এই বড়ি নিয়ে বই প্রকাশের ইচ্ছেও প্রকাশ করেন। শোনা যায়, মানিকবাবু যখন আগন্তুক ছায়াছবি করেছিলেন, তখন ময়না রাজ পরিবার থেকে গয়নাবড়ি আনা হয়েছিল।

1954 সালের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ৫৯তম অধিবেশনে গয়নাবড়ির প্রদর্শন হয়। 1990 সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত খাদ্যমেলায় তমলুকের বড়ি শিল্পীরা কলকাতার মানুষের সামনে গয়নাবড়ি বানিয়ে দেখান। 1995 সালে তমলুকে গয়নাবড়ির মার্কেটিং গ্রুপ তৈরি হয় বড়ি শিল্পকে আরো বেশি করে মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টায়। বর্তমানে পোস্ত , বিউলির ডাল দুটোরই লাগাম ছাড়া দামের দরুন এবং বড়ি বানিয়ে বিক্রি করার মত বাজার না পাওয়ায় এই শিল্প এখন প্রায় ধ্বংসের মুখে। যারা জানে তারা কিনে খায়, কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায় না সবসময় বাজারে। কিছু খাদ্যমেলা, খাদির মেলাগুলোতেই এগুলো দেখতে পাওয়া যায়।

তবে বাজারে এখন Maitree-র গয়না বড়ি বারোমাস পাওয়া যায়। সুন্দর করে বাক্সে ভরে তারা গয়নাবড়ি পৌঁছবার ব্যবস্থা করেছেন যাতে এই ভঙ্গুর শিল্পকলা যতটা সম্ভব ঠিক অবস্থায় বাঙালির রান্নাঘরে পৌঁছায়। আপনার পাতে গরম ভাতে ডালের সাথে গয়নাবড়ি দেখতে চাইলে একবার একটু whatsapp করে দেখতে পারেন এই নম্বরে 9804291227। 


Comments

Popular Posts